মলয়া সংগীতের জনক মনমোহন দত্ত।। বুনোহাঁস ফিচার
বৃহত্তর সিলেট হল গায়ক, সাধকদের পুণ্যভূমি। বাংলা শিল্প-সাহিত্য অনেক কিছু পেয়েছে এই পুণ্যভূমি থেকে। মলয়া সংগীতের জনক মনমোহন দত্ত তাঁদেরই একজন। বুনোহাঁসের এই ফিচার সমাজ সংস্কারক, গীতিকার, সুরকার ও গায়ক মনমোহন দত্তকে নিয়েই।
মনমোহন দত্ত ছিলেন মলয়া সংগীতের জনক, মরমী সাধক, মাইজভাণ্ডারী গানের গীতিকার, কবি, বাউল, সমাজ সংস্কারক ও অসংখ্য অসাধারণ গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। তিনি মনোমোহন সাধু নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন। তাকে পদকর্তা হিসেবেও আখ্যায়িত করা হত। মনমোহন দত্তের লেখা গানগুলো সুর দিয়েছেন ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ এর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আফতাবউদ্দিন খাঁ।
চট্টগ্রাম মাইজভান্ডারের পীর মাওলানা আহমদউল্লাহর সান্নিধ্যে গিয়ে তিনি তাঁর দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। মাইজভান্ডারের পরিবেশ তাঁকে অধ্যাত্মসঙ্গীত রচনায় উদ্বুদ্ধ করে। তিনি এ ধারায় গান রচনা করে সাধু ও সজ্জন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা ৮৫০।
জন্ম ও বংশপরিচয়ঃ
মনমোহন দত্ত ব্রিটিশ ভারতের ব্রাক্ষণবাড়ীয়া জেলার নবীনগর উপজেলার অর্ন্তগত সাতমোড়া গ্রামে ১২৮৪ বঙ্গাব্দের ১০ই মাঘ জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল পদ্মনাথ দত্ত ও মাতা্র নাম ছিল হর মৌহিনি। তাদের পারিবারিক পেশা ছিলো কবিরাজি। মনোমোহন দত্তের পূর্বপুরুষরা সোনার গাঁও ভট্টগ্রামের জমিদার ও এ অঞ্চলের প্রধান সাঁজওয়াল ছিলেন। সাঁজওয়াল বলতে সে সময় যারা বাদশাদের সৈন্য সামন্ত যোগান দিত তাদের বোঝায়। পরে ঐ বংশের একটা অংশ সাতমোড়া গ্রামে বসতি স্থাপন করে।
শিক্ষাজীবনঃ
মনোমোহন দত্তের শিক্ষা জীবন শুরু হয় গ্রামের রামজীবন চক্রবর্তী নামক এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের পাঠশালায় এবং পরে গ্রামের স্কুল থেকে মাইনর(পঞ্চম শ্রেণী) পাস করেন। তিনি পিতা পদ্মনাথ দত্ত পেশায় ছিলেন একজন কবিরাজ। গ্রামের রামজীবন চক্রবর্তীর পাঠশালা থেকে ছাত্রবৃত্তি পাস করে মনোমোহন মুরাদনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন, কিন্তু অর্থাভাবে পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়। পরে তিনি তিন বছর (১৮৯৬-১৮৯৯) মোক্তারি পড়েন। মোক্তারি পড়ালেখা শুরু করে শেষ পর্যন্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি।
পরিবারঃ
ছইফুল্লাকান্দি গ্রামের সাধ্বী সৌধামনি দত্তের সাথে ১৩০৮ সনের ২৮শে ভাদ্র সোমবার মনমোহন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের সংসারে একটি মাত্র সন্তান ছিল, নাম শ্রী সুধীরচন্দ্র দত্ত ।
কর্ম ও সাধনাঃ
মনোমোহন দত্ত এক জন সাধারন মানুষ ছিলেন। কিন্তু এক জন সাধারন মানুষও যে অসাধারনে রূপান্তরিত হতে পারেন, মহাঋষিতে পরিনত হতে পারেন-তার উজ্জল দৃষ্টান্ত মনোমোহন। এক জন মানুষ হৃদয়ে কেবল “গুরু সত্য” ও “জয় দয়াময়” অমঘ বানী হৃদয়ে ধারন করেব সাধন ভজনের মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে একটির পর একটি স্তর অতিক্রম করে এক জন মহা মানবে পরিণত হয়েছেন, ব্রহ্মজ্ঞানে জ্ঞান লাভ করেছেন, জ্যোতিষ্মান হয়েছেন।
তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মানুষ যে যে ধর্মই পালন করে থাকুক তা একই স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। তাই তিনি ধর্ম বিভেদ ঘুচাতে সর্ব ধর্মকে সমন্বয় করে “জয় দয়াময়” জপ প্রচার করে গেছেন। মনোমোহন সাধুর জীবন ছিল বড়ই বৈচিত্র্যময়। পরিবার স্বচ্ছল ছিলনা। ফলে জীবিকা অর্জনের জন্য ছুটে বেরিয়েছেন ময়মনসিংহ থেকে চট্টগ্রাম। কিন্তু কোথাও কিছু হয়নি।
কিন্তু তিনি যে “ধর্ম ধন” উপার্জন করেছেন, সে ধনের কাছে জগতের সকল ধন পরাস্ত হয়েছে। তার গুরু ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল নিবাসী আচার্য আনন্দ স্বামী। তার মধ্যে একটা সহজাত গুরু ভক্তি ছিল। তার বাড়িতে তিনি তার গুরুর নামে “আনন্দ আশ্রম” নামে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। তার সাধন ভজন প্রক্রিয়াছিল অনেক আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ। তার আধ্যাত্মিকতার ব্যাপারে কিছু ঘটনা প্রচলিত আছে। এর মধ্যে একটি হল- তিনি তার মৃত্যুর পর তার প্রিয় শিষ্য যাদের সাথে মৃত্যুর আগে দেখা হয়নি তাদের সাথে দেখা করেছেন- এর মধ্যে এক জন হলেন গ্রামের এক মাঝি ও এক মুদি দোকানদার।
মলয়া সংগীতঃ
গাউছুল আজম হযরত শাহ্ সূফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ্ (রঃ) এর সাথে সাক্ষাতের পর মনোমোহন দত্তের জীবন ও জগত সমন্দে দৃষ্টি ভঙ্গীর ব্যাপক পরিবর্তন আসে। সেখানে কিছু দিন থেকে তিনি সঙ্গীতের তালিম নেন এবং গান রচনার পুলকিত প্রেরনা লাভ করেন। মনোমোহন দত্ত “মলয়া” সঙ্গীতের স্রষ্টা।
মলয়া বলতে বুঝায় মলয় পর্বত হতে আগত দখিনা বায়ু।কিন্তু লোক মুখে মলয়া বলতে যা জানা যায় তা হল তিন জনের নামের অদ্যাক্ষর দিয়ে মলয়ার সৃষ্টি (গানের রচয়িতা মনোমোহন, গানের সংরক্ষক তাঁর প্রিয় শিষ্য লবচন্দ্র ও গানের সুরকার আফতাব উদ্দিন খাঁ। আফতাব উদ্দিন খাঁ ছিলেন সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর বড় ভাই)।
মনোমোহন প্রায় ৮৫০ টি গান রচনা করেন এবং এর মধ্যে প্রায় ২৮৭ টি গান মলয়া এক ও মলয়া দুই বইয়ে সন্নিবেশিত হয়েছে। তার অসংখ্য গান এরিমধ্যে হারিয়ে গেছে। এছাড়াও তিনি প্রায় ১৮ টি বই রচনাকরেন। এর মধ্যে লীলারহস্য, উপবন, তপোবন, মলয়া এক, মলয়া দুই উল্লেখযোগ্য। প্রতি বৎসর ১০ ই মাঘ সাতমোড়া গ্রামের আনন্দ আশ্রমে মনোমোহন স্মরণ উৎসব পালিত হয় ।
মনোমোহন নিয়মিত কুরআন ও বাইবেল পড়তেন; বেদ-বেদান্তেও তাঁর ব্যুৎপত্তি ছিল। তাঁর গানের একটি উক্তি হলো:
‘কোরান, পুরাণ, আদি বাইবেল কী বেদ, সবে ফুঁকারিয়া কয়, তাঁর অবিচ্ছেদ।’
তিনি গুরুর নামে আনন্দাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন; সেখানে প্রতিরাতে জলসা হতো। পরবর্তীকালে মনোমোহনের জন্মোৎসব উপলক্ষে প্রতিবছর ১০ মাঘ ভক্তরা তাঁর গান পরিবেশন করতেন। তাঁর একমাত্র সন্তান সুধীরচন্দ্র দত্ত আশ্রমের সার্বিক তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
মনোমোহনের শিষ্যবর্গের মধ্যে খ্যাতনামা সুরকার আফতাবউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ গুল মোহাম্মদ খাঁ, নিশিকান্ত সেন ও লবচন্দ্র পালের নাম উল্লেখযোগ্য। আফতাবউদ্দিন মনোমোহনের গানে সুরারোপ করেন। মনোমোহনের প্রথম সঙ্গীত-সংকলন মলয়া (২ খন্ড); অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে পথিক, পাথেয়, কথামৃত, যোগপ্রণালী, খনি ইত্যাদি। ১৩১৬ বঙ্গাব্দের (১৯০৯) ২০ আশ্বিন তিনি পরলোক গমন করেন এবং তাঁর ইচ্ছানুযায়ী লাশ কবর দেওয়া হয়। [সূত্র: আলি নওয়াজ]
উল্লেখযোগ্য রচনাবলী:
মলয়া – প্রথম খন্ড
মলয়া – দ্বিতীয় খন্ড
প্রেমারিজাত
খনি (দয়াময়)
পথিক
পাথেয়
ময়না
যোগ প্রণালী
লীলারহস্য
তিনি এক মাত্র পুত্র শ্রী সুধীরচন্দ্র দত্তকে রেখে বাঙলা ১৩১৬ সনের ২০শে আশ্বিন মাত্র ৩১ বছর ৯ মাস বয়সে দেহত্যাগ করেন।
তথ্যসূত্র:
উইকিপিডিয়া, আলি নওয়াজ,
লীলারহস্য, মনোমোহন দত্ত, আনন্দ আশ্রম, সাতমোড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
শ্রী বিল্বভূষণ দত্ত, অধ্যক্ষ, আনন্দ আশ্রম, সাতমোড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। (সাধক মনোমোহন দত্তের নাতি)।
বাংলাপিডিয়া, সামহোয়্যারইন ব্লগ ইত্যাদি।














