মাতাল কবি রাজ্জাক দেওয়ান।। লোকসংগীত জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র
মাতাল কবি রাজ্জাক দেওয়ান বাংলাদেশের লোকসংগীতের জগতে একজন বিখ্যাত বাউল ও মরমী গায়ক। তিনি মূলত তার দেহতত্ত্ব ও আধ্যাত্মিক গানের জন্য পরিচিত। “মাতাল কবি” উপাধিটি তার জীবনের উদ্দামতা, স্রষ্টার প্রতি গভীর প্রেম এবং গান-আড্ডায় মত্ত থাকার জীবনধারা থেকে এসেছে। রাজ্জাক দেওয়ানের গানগুলোতে সহজ-সরল গ্রাম্য ভাষা এবং গভীর দর্শনের মেলবন্ধন দেখা যায়, যা সাধারণ মানুষের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে।
রাজ্জাক দেওয়ানের গানের বৈশিষ্ট্য:
1. দেহতত্ত্ব: তার গানে দেহতত্ত্ব ও আত্মার গভীর দার্শনিক ভাবনা ফুটে ওঠে।
2. স্রষ্টাপ্রেম: তার গানে স্রষ্টার প্রতি প্রেম, মানবতা, এবং আধ্যাত্মিকতার বিষয়গুলো প্রধান।
3. লোকজ সুর: গানগুলোতে বাংলার লোকজ সুর ও তালের ব্যবহার রয়েছে, যা শ্রোতাদের আকর্ষণ করে।
4. প্রকৃতির সাথে সংযোগ: তার গানে প্রকৃতি, নদী, গ্রামীণ জীবনের কথা উঠে আসে।
রাজ্জাক দেওয়ান তার মঞ্চ পরিবেশনা এবং গান গাওয়ার ধরনে সহজেই মানুষের মন জয় করতেন। তার গান শুধু বিনোদন নয়, বরং শ্রোতাদের মাঝে আধ্যাত্মিক চেতনার জন্ম দিত।
মাতাল কবি রাজ্জাক দেওয়ান বাংলাদেশের লোকগানের জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি বাউল, মরমী এবং আধ্যাত্মিক ধারার গানের জন্য খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার সৃষ্ট গানগুলো গ্রামীণ জীবনের অনুভূতি এবং আধ্যাত্মিকতার গভীর ভাবনা তুলে ধরেছে।
জন্ম ও শৈশব
রাজ্জাক দেওয়ানের জন্ম বাংলাদেশের এক গ্রামীণ এলাকায়। তার সঠিক জন্মসাল নিয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য নেই, তবে তিনি ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি গভীর আকর্ষণ অনুভব করতেন। তিনি গ্রামের মেলা ও বাউল সাধকদের আসরে গান শুনে প্রভাবিত হন। তার দারিদ্র্যপূর্ণ শৈশব জীবনে গানই ছিল আত্মার শান্তি খোঁজার মাধ্যম। বিভিন্ন তথ্যমতে মাতাল কবি আব্দুর রাজ্জাক দেওয়ান একজন প্রখ্যাত বাউল ও মরমী সাধক ছিলেন। তিনি ১৯৩৩ সালের ২৭ আগস্ট ঢাকার কেরানীগঞ্জের ওয়াসপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার গানের গুরু ছিলেন বাউল সাধক খালেক দেওয়ান, যার কাছ থেকে তিনি বাউল গানের শিক্ষা গ্রহণ করেন।
মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান তার জীবনে অসংখ্য গান রচনা ও পরিবেশন করেছেন, যা বাংলা লোকসঙ্গীতের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। তার কিছু জনপ্রিয় গান হলো “মদ খেয়েছি মাতাল হয়েছি”, “সুখ পাখিটা গেছে মারা”, “ভুল বুঝে চলে যাও যত খুশি ব্যথা দাও” ইত্যাদি।
সংগীত জীবন
রাজ্জাক দেওয়ান সংগীত শেখার কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা না নিয়েও তার প্রতিভার মাধ্যমে একজন অসাধারণ গায়ক হয়ে ওঠেন। তিনি বাউল এবং দেহতত্ত্বের গানের প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন এবং নিজে গান লিখতে শুরু করেন। তার গানে দেহতত্ত্ব, আধ্যাত্মিকতা, এবং মানবজীবনের গভীর প্রশ্নের প্রতিফলন দেখা যায়।
তিনি গান পরিবেশনের সময় নিজেকে একেবারে গান ও দর্শকদের মধ্যে মিশিয়ে দিতেন। তার জীবনদর্শন এবং গান লেখার কৌশল তাকে “মাতাল কবি” হিসেবে খ্যাতি এনে দেয়। মাতাল বলতে এখানে তার উদাসীনতা, স্রষ্টার প্রতি গভীর প্রেম, এবং জীবনের বাঁধাধরা নিয়মের প্রতি অবহেলার ভাব প্রকাশ করা হয়।
মাতাল কবি আব্দুর রাজ্জাক দেওয়ানের সংগীত জীবন ছিল বর্ণাঢ্য ও বৈচিত্র্যময়। তিনি মূলত বাউল, মরমী, ও লোকগানের ধারার একজন অগ্রণী শিল্পী। তাঁর সংগীত জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত:
গানের শুরু
রাজ্জাক দেওয়ান বাউল গানের প্রতি আকৃষ্ট হন শৈশবেই। তাঁর গানের গুরু ছিলেন খালেক দেওয়ান। গুরুর কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে তিনি গানের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেন।
তিনি বাংলা লোকগানের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করতে অসংখ্য জনপ্রিয় গান রচনা করেছেন।
গানের বৈশিষ্ট্য
তাঁর গানের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল মরমী দর্শন, আত্মশুদ্ধি, প্রেম এবং মানবিকতার বার্তা।
তাঁর গানগুলোতে মাতাল সুর ও কথার গভীরতা এতটাই প্রভাব ফেলত যে তিনি “মাতাল কবি” নামে পরিচিতি লাভ করেন।
জনপ্রিয় গান
তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য গান:
1. “মদ খেয়েছি মাতাল হয়েছি”
2. “ভুল বুঝে চলে যাও”
3. “সুখ পাখিটা গেছে মারা”
4. “দুনিয়া মায়ার খেলা”
সংগীতের মাধ্যমে বার্তা
তাঁর গানে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেমের প্রতিফলন দেখা যায়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি গান গেয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতেন।
তিনি তাঁর গান দ্বারা সামাজিক অন্যায়ের প্রতিবাদও করতেন।
পরবর্তী প্রজন্মের প্রভাব
তাঁর সন্তান কাজল দেওয়ান ও অন্যান্য উত্তরাধিকারীরা তাঁর গানকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। কাজল দেওয়ান এখনো বাউল গান পরিবেশন করেন এবং তাঁর বাবার ঐতিহ্য বহন করছেন।
উল্লেখযোগ্য অবদান
মাতাল রাজ্জাক দেওয়ান বাউল গানকে শুধু সংগীতের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি; তিনি এটি একটি দর্শন ও জীবনের পথ হিসেবে মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন। তাঁর গান বাংলার লোকজ সঙ্গীতের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁকে স্মরণ করে চলেছে।
ব্যক্তিগত জীবন
রাজ্জাক দেওয়ান ছিলেন সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ। তার জীবনের অধিকাংশ সময়ই তিনি গ্রামে কাটিয়েছেন, যেখানে তিনি গান লিখতেন এবং সাধুসঙ্গ করতেন। তিনি লোকসংগীতের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতির কথা তুলে ধরতেন।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
রাজ্জাক দেওয়ান তার সৃষ্ট গান এবং জীবনযাপনের মাধ্যমেই অমর হয়ে আছেন। তার মৃত্যুর পরেও তার গানগুলো গ্রামীণ মেলা, বাউল আসর এবং সংগীতপ্রেমীদের মনে জীবন্ত হয়ে আছে। তার সৃষ্ট গানগুলো পরবর্তী প্রজন্মের বাউল গায়কদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।
তার জীবন নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তার সৃষ্টির মূল অনুপ্রেরণা, জীবনের ঘটনা এবং তার গানের বৈশিষ্ট্যগুলো গভীরভাবে বোঝা যায়। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় বেহালা বাজিয়ে ও গান গেয়ে সাধারণ মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ২০০৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
প্রারম্ভিক জীবন ও সংগীতের প্রতি আকর্ষণ
রাজ্জাক দেওয়ানের জন্ম বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। তার শৈশব কাটে সাধারণ গ্রামীণ পরিবেশে, যেখানে গান ও লোকসংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা তার হৃদয়ে জাগ্রত হয়। শোনা যায়, তিনি ছোটবেলায় গ্রামে সাধু ও বাউলদের গান শুনে মুগ্ধ হতেন। তার এই আগ্রহই পরবর্তীতে তাকে বাউল ও দেহতত্ত্বের গানে আকৃষ্ট করে।
তিনি দারিদ্র্যকে সঙ্গী করে বড় হয়েছেন, কিন্তু এই দারিদ্র্যই তাকে জীবনের গভীরতা অনুধাবনে সহায়ক হয়েছে। তার জীবনসংগ্রামের অভিজ্ঞতা এবং স্রষ্টার প্রতি প্রেম তাকে “মাতাল কবি” হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।
সংগীত ও দর্শন
রাজ্জাক দেওয়ানের গানে দেহতত্ত্বের প্রতি গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, দেহই হলো স্রষ্টার বসতি এবং এই দেহের ভেতরেই আত্মাকে খুঁজে পাওয়া যায়। তার গানের কয়েকটি জনপ্রিয় থিম হলো:
1. আত্ম-অনুসন্ধান: নিজেকে জানার মধ্যে স্রষ্টার উপলব্ধি।
2. দেহতত্ত্ব ও আধ্যাত্মিকতা: দেহ ও আত্মার মধ্যে সম্পর্ক।
3. মানবিক মূল্যবোধ: মানুষের প্রতি প্রেম, সাম্য এবং মানবতার গুরুত্ব।
4. প্রকৃতি ও স্রষ্টার সৃষ্টির মহিমা।
তার গানের লিরিকগুলো সাধারণ মানুষের কথা ও ভাষায় রচিত, যা সহজেই মানুষের হৃদয় স্পর্শ করে।
ব্যক্তি জীবন ও আচার-আচরণ
রাজ্জাক দেওয়ান ছিলেন এক অমায়িক এবং নিরহংকারী মানুষ। তিনি গ্রামীণ মেলাগুলোতে গান পরিবেশন করতেন এবং বাউল সাধুদের সঙ্গে আড্ডায় অংশ নিতেন। তার আধ্যাত্মিক জীবন এবং মানুষের সঙ্গে সহজ-সরল মেলামেশা তাকে জনপ্রিয় করে তোলে।
শেষ জীবন ও উত্তরাধিকার
রাজ্জাক দেওয়ানের শেষ জীবনও খুবই সাধারণভাবে কেটেছে। তিনি তার জীবনকে গান ও আধ্যাত্মিকতার জন্য উৎসর্গ করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর তার গানগুলোই তাকে বেঁচে রেখেছে। আজও গ্রামীণ মেলায় এবং বিভিন্ন লোকসঙ্গীতের অনুষ্ঠানে তার গান পরিবেশিত হয়।মাতাল কবি আব্দুর রাজ্জাক দেওয়ান ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাউল ও মরমী সাধক। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে তিনি নাছিমা দেওয়ানকে বিবাহ করেন।
তাঁর সন্তানদের মধ্যে কাজল দেওয়ান উল্লেখযোগ্য, যিনি পিতার সঙ্গীত ঐতিহ্যকে ধারণ করে বাউল গানের চর্চা ও প্রচার করে চলেছেন।
এছাড়া, তাঁর ছোট ছেলে সুজন দেওয়ানও বাউল সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন; তবে তিনি দুঃখজনকভাবে ইহলোক ত্যাগ করেছেন।
মাতাল রাজ্জাক দেওয়ানের উত্তরাধিকারীরা তাঁর সঙ্গীত ও দর্শনকে জীবিত রেখে বাংলা লোকসঙ্গীতের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করছেন।
রাজ্জাক দেওয়ানের প্রভাব
রাজ্জাক দেওয়ান বাংলাদেশের লোকগানের ভাণ্ডারে এক মূল্যবান রত্ন। তার গানগুলো কেবল বিনোদনের জন্য নয়, বরং আধ্যাত্মিক শিক্ষা এবং মানুষের মধ্যে সাম্যবাদ প্রচারের জন্যও জনপ্রিয়। পরবর্তী প্রজন্মের বাউল ও মরমী গায়কদের ওপর তার গভীর প্রভাব পড়েছে।
তার ব্যাপারে বিশদ তথ্য ও নির্দিষ্ট গান জানতে চাইলে কিছু প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে হবে, কারণ তার অনেক গান গ্রামীণ মেলা ও লোকসংগীতের আসরে জনপ্রিয় হয়েছে।
তার কয়েকটি জনপ্রিয় গান:
1. “তোর জন্যই মন পাগল রে”
এই গানটি প্রেম ও বিরহের গল্পে গাঁথা। স্রষ্টার প্রতি গভীর প্রেমও এতে প্রকাশ পায়।
2. “আমার দেহ ঘরখানায় কে থাকে”
দেহতত্ত্বের গান হিসেবে এটি খুবই জনপ্রিয়। দেহের ভেতরে আত্মার উপস্থিতি নিয়ে গভীর দর্শন তুলে ধরা হয়েছে।
3. “মাতাল হইয়া গেলাম”
এটি তার পরিচিত গানগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে স্রষ্টার প্রতি প্রেমে মাতাল হওয়ার ভাব প্রকাশিত হয়েছে।
তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা:
1. স্রষ্টা খোঁজার যাত্রা:
রাজ্জাক দেওয়ান জীবনের প্রথম দিকেই স্রষ্টার প্রতি গভীর আকর্ষণ অনুভব করেন। তিনি বিভিন্ন সাধুর সান্নিধ্যে থেকে আধ্যাত্মিকতায় দীক্ষিত হন।
2. গ্রামীণ মেলার গান:
তিনি গ্রামীণ মেলা এবং বাউল গানের আসরে গান গেয়ে মানুষের মন ছুঁয়ে যেতেন। তার সহজ-সরল উপস্থাপনা এবং গভীরতাপূর্ণ গানের কথা মানুষকে ভাবতে বাধ্য করত।
3. মরমী সাধকদের প্রভাব:
লালন ফকির, হাছন রাজা, এবং শীতলং শাহ প্রমুখ মরমী গীতিকারের প্রভাব তার গানে পড়েছে। তবে তিনি নিজস্ব কণ্ঠে নতুন ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন।